আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির এই যুগে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে ভারত তথা বিশ্বের মানবসভ্যতার ইতিহাস ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হচ্ছে। জিপিএস, কার্বন ১৪ ডেটিং, অক্সিজেন আইসোটোপ ডেটিং জাতীয় প্রযুক্তির সফল প্রয়োগের ফলে ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে ইতিহাসে কল্পনাবিলাসের পরিসর। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের আইআইটি খড়্গপুরের আর্কিটেকচার ও জিওলজি বিভাগ এই ধরণের গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। আসুন দেখে নিই এই বিভাগের প্রথিতযশা বিজ্ঞানীরা অন্যান্য বিভাগ এবং দেশ-বিদেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ইতিহাসের জগতে যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, তার কিছু নমুনা।
১. লাদাখের ৎসো মোরিরি হ্রদ, হরিয়ানার ভিরানা এবং গুজরাতের ধোলাভিরায় দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে তাঁরা সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা সম্পর্কে বেশ কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। হ্রদে যেমন তাঁরা গত ৫০০০ বছরের বর্ষার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেছেন, সেরকমই সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার প্রাচীন দুই কেন্দ্রে প্রাপ্ত বিভিন্ন পশুর হাড়, শিং, দাঁত, শামুকের খোলস, মাছের অবশিষ্টাংশ, গয়নাগাটি, বাসনকোসন প্রভৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। এভাবে তাঁরা বুঝেছেন, প্রাক-সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার উৎপত্তি ৯০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পশুপালন ও কৃষিকাজ নির্ভর গ্রামীণ সভ্যতা থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে নগর সভ্যতা। প্রথম কয়েক হাজার বছরের বর্ষার অনুকূল পরিস্থিতি এই সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তারে সহায়ক হয়েছিল। ভিরানা কেন্দ্রটি যেমন এক প্রাচীন বরফগলা জলে পুষ্ট নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল, সেরকমই ধোলাভিরা অঞ্চলেও হিমবাহ গলিত জল এবং ম্যানগ্রোভ অরণ্যের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই আবিষ্কার থেকে বেদে বর্ণিত সরস্বতী নদীর কথাই মনে পড়ে। ২৩৫০-১৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে বর্ষা প্রতিকূল হয়ে পড়ে। দীর্ঘ খরার প্রকোপে অবনগরায়ন ঘটে, এবং মানুষজন ধীরে ধীরে দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে এগোতে এগোতে কৃষি ও পশুপালন নির্ভর সভ্যতায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। উন্নত জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা তৈরী এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেও শেষরক্ষা হয় নি।
২. বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রাপ্ত পবিত্র স্বস্তিকা চিহ্ন এবং তার নানা রূপভেদের প্রাপ্তিস্থল ও প্রাচীনত্ব নিয়ে গবেষণা করে তাঁরা বেশ কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন যে এই চিহ্ন অন্তত ১১০০০ বছরের পুরনো। প্রাক-হরপ্পা যুগের সীলে স্বস্তিকার স্পষ্ট রূপ তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন। পরবর্তীকালে এই চিহ্ন তাতার মোঙ্গল পথ ধরে কামচাটকা হয়ে পৌঁছে যায় উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়, অন্যদিকে আবার এই একই চিহ্ন পৌঁছে যায় ইউরোপের ব্রিটেন, ফিনল্যান্ড, স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়। এই যাবতীয় তথ্য সারা পৃথিবীকে ৯ টি বৃহৎ অঞ্চলে ভাগ করে সীল, লেখ, চিত্র এবং স্থানীয় ধর্মীয় ইতিহাস নিয়ে গভীর এবং আকর্ষক গবেষণার ফসল। গবেষকরা এও জানতে পেরেছেন যে ঋগ্বেদের মৌখিক রূপ প্রাক-হরপ্পা সভ্যতার সমসাময়িক, এবং এতেও স্বস্তিকার পরিষ্কার উল্লেখ তাঁরা পেয়েছেন।
৩. বারাণসী শহরের বিভিন্ন স্থানে গভীর গর্ত খুঁড়ে জিপিএস ব্যবহার করে তাঁরা গত ৬৫০০ বছর ধরে একটানা জনবসতির প্রমাণ পেয়েছেন। অর্থাৎ, এই শহর সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার সমসাময়িক। ভূগর্ভের গভীরে তাঁরা গঙ্গা নদীর প্রাচীন ধারাগুলির সন্ধান পেয়েছেন। এরই সাথে সাথে বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে বর্ণিত বহু বিষয়ের ঐতিহাসিক অস্তিত্বের প্রমাণ তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন, যেমন নৈমিষারণ্য এবং আনন্দবন।
৪. মেঘালয়ের বাহ শিকার গুহার স্ট্যালাগমাইটের অক্সিজেন ডেটিং করে তাঁরা জানতে পেরেছেন ১২১০ ও ১৩২০ খ্রিস্টাব্দের সারা ভারত ব্যাপী দুটি ভয়াবহ বন্যার কথা, যার ফলে কৃষি নির্ভর অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই একই সময়ে সেন, সোলাঙ্কি, পারমার, যাদব, পাণ্ড্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, যার কারণ হতে পারে এই দুই বিধ্বংসী বন্যা।
আইআইটি খড়্গপুরের আর্কিটেকচার বিভাগের জয় সেন এবং জিওলজি বিভাগের অনিল গুপ্ত ও অনিন্দ্য সরকার এই গবেষণাগুলির পুরোধা। গবেষণাগুলি এখনই সম্পূর্ণ হয় নি, বরং এগুলির লক্ষ্য ও বিস্তৃতি আরও বাড়ানো হয়েছে ও হচ্ছে। আবরণ উন্মোচিত হচ্ছে বিশ্বের ইতিহাসের বিভিন্ন অজানা অধ্যায়ের। বিভিন্ন আইআইটি, এনআইটি, এএসআই, পিআরএল-আমেদাবাদ, এসপিএ-ভূপাল, ডেকান কলেজ-পুণে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সহ আরও বহু প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে চলেছেন। খুব শীঘ্রই এঁরা প্রকাশ করতে চলেছেন রামায়ণের ঐতিহাসিকতার বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ।