Tapash Hindu's Album: Wall Photos

Photo 12 of 15 in Wall Photos

আমরা সবাইকে নমস্কার বলি কেন?
নমস্কার বা নমস্তুতে সংক্ষেপে নমস্তে হচ্ছে বৈদিকযুগ হতে প্রচলিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কর্তৃক ব্যবহৃত অভিবাদন সূচক শব্দ। সাধারণত দুই হাত জোড় করে 'নমস্কার' শব্দটি উচ্চারণ করা হয়ে থাকে বলে একে অঞ্জলি মুদ্রা বা প্রণামও বলা হয়।
নমস্কার শব্দের অর্থ কি?

'নমস্কার' শব্দটি এসেছে মূল সংস্কৃত শব্দ 'নমঃ' থেকে যার আভিধানিক অর্থ সম্মানজ্ঞাপন পূর্বক ভগবান রূপী আত্মার নিকট অবনত হওয়া।
নমস্তে শব্দের অর্থ কি?

"নমস্তে অর্থাত্‍ আমি তোমায় মান্য করি-তোমার সমাদর করি বা তোমায় শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
পবিত্র বেদে নমঃ, নমস্তে শব্দ বারবার উল্লেখ আছে, কিন্তু আমাদের হিন্দুদের মধ্যেও মত ও পন্থবাদীরা অনেক নানা শব্দ কল্পনা করে হাত জোর করে নমস্তে না বলে যদি আমরা "জয় শিব", "জয় হরি", "জয় গোবিন্দ", "জয় রাধেশ্যাম", "জয় রামজী", "জয় কৃষ্ণজী", "হরে কৃষ্ণ", "জয়গুরু", প্রভৃতি অনেক সম্ভাষণ শব্দ প্রয়োগ করে থাকি।

এইরূপ বলা যায় তাতে দোষ কি আছে?

নমস্কার এর রেফারেন্স দেওয়া যাবে। পবিত্র বেদে কোথাও যদি "জয় শিব", "জয় হরি", "জয় গোবিন্দ", "জয় রাধেশ্যাম", "জয় রামজী", "জয় কৃষ্ণজী", "জয়গুরু", "হরেকৃষ্ণ" টাইপ্স এর যত সম্বোধন আছে সে গুলো দেখাবেন।

এখন আমার প্রশ্ন তাদের নিকট যারা বেদ গীতা উভয় মান্য করেন বা জানেন, কিন্তু তারাও এসব অ'শাস্ত্রীয় সম্বোধন কোন গ্রন্থ অনুসারে করেন, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ষোল'সংস্কার হয় বা ইত্যাদি এই পবিত্র বেদ নিয়ম অনুসারে করেন, কিন্তু সম্বোধন এর ক্ষেত্রে ভিন্ন কেন?

আদি ধর্মগ্রন্থ পবিত্র বেদেই কেন, বাল্মীকী'রামায়ণ, মহাভারত, ­উপনিষদ্ প্রভৃতি সমস্ত গ্রন্থে "নম" ও "নমস্তে" শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। রামায়নের কোথাও বা মহাভারতের কোথাও "জয় শিব", "জয় হরি", "জয় গোবিন্দ", "জয় রাধেশ্যাম", "জয়গুরু", "জয় রামজী", "হরে কৃষ্ণ" "জয় কৃষ্ণজী" "জয় শ্রী রাম" উল্লেখ নেই।

ভারতের বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরে এবং প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনে শ্রীরাম চন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং নমস্তে ব্যবহার করতেন। বৈদিক ধর্মালম্বী বিভিন্ন ব্যক্তিত্ত্বের নমস্কাররত অবস্থায় খচিত নকশা পাওয়া যায়। আপস্তম্ব ও বৌধায়ন সুত্রেও অভিবাদনের নিয়ম হিসেবে নমস্কার দেবার কথা পাওয়া যায়। পবিত্র বেদে অনেকবারই নমঃ, নমস্তে তথা নমস্কারের উল্লেখ পাওয়া যায়। নমঃ নমস্তে শব্দের বাংলা ভাষায় যাকে বলা হয় নমস্কার। হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুসারে ভগবান প্রত্যেক জীবের মাঝেই আত্মা'রূপে বিরাজ করেন তাই, নমস্কার জ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষের ভিতরের পর'আত্মা'রূপী স্রষ্টার নিকট অবনত হওয়াকেই বুঝায়।

নমস্কার কি সকলকে জানানো যায়?

সনাতন ধর্ম বিরোধী নানা কুপ্রচারণার অংশ হিসেবে একশ্রেণীর কুচক্রী মহল প্রচার করে চলেছে যে যেহেতু, নমস্কার শব্দটি অবনত হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট তাই সাধারণ জনগণকে নমস্কার জানানো উচিত নয়। দেখা যাক, এই সম্পর্কে বৈদিক শাস্ত্র কি বলে—

বৈদিক সান্ধ্য উপাসনার শেষ ধাপে যখন ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে মুদ্রা করা হয় তখন একে বলে প্রনাম বা আসন। মূলত শব্দটি হল ‘নমস্তে’ যার বাংলা রুপ হল নমস্কার। ‘নম’ শব্দের অর্থ হল নত হওয়া, শ্রদ্ধা বা সম্মান প্রদর্শন করা যার সাথে ‘তে’ ধাতু যুক্ত হয় যার অর্থ তোমাকে অর্থাত্ন মস্তে অর্থ হল তোমার প্রতি রইল শ্রদ্ধা বা সম্মান।

অভিবাদনরুপে নমস্কার প্রদানের উত্কৃষ্ট উদাহরন যজুর্বেদের নিম্নলিখিত মন্ত্রটি,

"নমস্কার হল বৈদিক অভিবাদন"
পবিত্র বেদে বলছে,

নমো জ্যেষ্ঠায় চ কনিষ্ঠায় চ
নমং পূর্বজায় চাপরজায চ
নমো মধ্যমায় চাপগল্ভায় চ
নমো জঘন্যায় চ বুধ্ন্যায় চ ।।
(যজুর্বেদ ১৬/৩২)

অনুবাদঃ— নমস্কার জ্যৈষ্ঠদের কে, নমস্কার কনিষ্ঠদের কে, নমস্কার উচ্চবিত্ত, নমস্কার মধ্যবিত্ত, ধনী-গরীব জ্ঞানী, স্বল্পজ্ঞানী সকলকে।

ওঁ নমস্তে অস্তু আয়তে নমোঃ অস্তু পরায়তে
নমস্তে রুদ্র তিষ্টত আসীনা য়োততে নমঃ।
(অথর্ববেদ, ১১/২/৪৬)

অনুবাদঃ— ছোটরা বড়দের "নমস্তে" বললে এর অর্থ আমি আপনাকে শ্রদ্ধা, ভক্তি ও সম্মান করি। বড়রা ছোটদের বললে এর অর্থ আমি তোমাকে স্নেহ করি আদর করি ভালবাসি।

নমস্তে স্ত্বায়তে নমো অস্তু পরায়তে।
নমস্তে রুদ্র তিষ্ঠতে আসীনাযোত তে নমঃ।।
(অথর্ববেদ ১১/২/১৫)

অনুবাদঃ— নমস্কার তোমায় (কেননা) আমাদেরকে দেয়া চৈতন্যের জন্য, হে রুদ্র তোমায় নমস্কার কেননা তুমিই এই বিবেকরুপে আমাদের মাঝে অবস্থান কর।

নমস্কার এছাড়াও বেদের অসংখ্য স্থানে পাওয়া যায়— (ঋগ্বেদ ৮/৭৫/১০; যজুর্বেদ, ১৬/৩২, ১৬/৪১; অথর্ববেদ ২/৮/৪, ৬/১৩/২, ১০/৭/৩২-৩৪, ১০/৮/১, ১০/৮৫/২২, ১১/২/১৫, ১১/২/৪৬)।

অধিষ্ঠাতা
যো ভূতং চ ভব্যং চ সর্ব্বং যশ্চাধিতিষ্ঠতি।
স্বর্যস্য চ কেবলং তস্মৈ জ্যেষ্ঠায় ব্রহ্মণে নমঃ।।
(অথর্ববেদ, ১০/৮/১)

অর্থাৎঃ— যিনি ভূতকাল, ভবিষ্যৎ কাল, এবং নিখিল জগতের অধিষ্ঠাতা, সুখই যাঁহার কেবল স্বরূপ সেই সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ ব্রহ্মকে নমস্কার।

আরেকটি মন্ত্র কৃষকদের অভিনন্দন জানাতে গিয়ে বলছে,

নমস্তে লাঙ্গলেভ্যো নম
বিরুত্ক্ষেত্রিযনাশন্যপা
(অথর্ববেদ, ২/৮/৪)

অর্থাৎঃ— যারা লাঙ্গল ও চাষের মাধ্যমে জমিতে ফসল ফলান তাদের জানাই নমস্কার।

বিশ্বরূপ যস্য ভূমিঃ প্রমান্তরিক্ষমুতোদরম্।
দিবং যশ্চক্রে মুর্ধানং তস্মৈ জ্যেষ্ঠায় ব্রহ্মণে নমঃ।।
(অথর্ববেদ, ১০/৭/৩২)

অর্থাৎঃ— ভূমি যাঁহার পাদমূল সদৃশ্য, অন্তরিক্ষ যাঁহার উদর সদৃশ্য, দ্যুলোককে যিনি মস্তক সদৃশ্য সৃষ্টি করিয়াছেন সেই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ ব্রহ্মকে নমস্কার।।

চক্ষু যস্য সূর্য শ্চক্ষুশ্চন্দ্রমাশ্চপুনর্ণবঃ।
অগ্নিং যশ্চক্র আস্যং তস্মৈ জ্যেষ্ঠায় ব্রহ্মণে নমঃ।।
(অথর্ববেদ, ১০/৭/৩৩)

অর্থাৎঃ— সৃষ্টির আদিতে বার বার নব নব রূপ ধারণ করিয়া সূর্য-চন্দ্রকে যাঁহার নেত্র সদৃশ, অগ্নিকে যিনি মুখ সদৃশ সৃষ্টি করিয়াছেন সেই শ্রেষ্ঠ পুরুষ ব্রহ্মকে নমস্কার।।

প্রাণাপান যস্য বাতঃ প্রাণাপানৌ চক্ষুরঙ্গিরসোহভবন্।
দিশো যশ্চক্রে প্রজ্ঞানী তস্মৈ জ্যেষ্ঠায় ব্রহ্মণে নমঃ।।
(অথর্ববেদ, ১০/৭/৩৪)

অর্থাৎঃ— বায়ু যাঁহার প্রাণ ও অপান সদৃশ, রশ্মিসমূহ যাঁহার চক্ষু সদৃশ, দিক্ সমূহ যাঁহার প্রজ্ঞা সদৃশ, সেই শ্রেষ্ঠ পুরুষ ব্রহ্মকে নমস্কার।।

শঙ্কর নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায়চ নমঃ
শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ নমঃ শিবায় চ শিবতরায়চ।।
(যজুর্বেদ, ১৬/৪১)

অর্থাৎঃ— কল্যাণ ও সুখের কারণকে নমস্কার। কল্যাণ দাতা ও সুখদাতাকে নমস্কার। কল্যাণময় ও সুখময়কে নমস্কার।।

উপনিষদ বলেছে,

"যো দেবো অগ্নৌ যো অপসু যো বিশ্বং ভূবনাবিবেশ য ওষধীষু যো বনস্পতি তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ॥"
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ২-১৭)

(ঈশোপনিষদ ১৮ নং মন্ত্র, মুণ্ডকোপনিষদ ৩/২/১১ নং মন্ত্র, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ২/১৭, তৈত্তরীয় উপনিষদ ১/১, প্রশ্ন উপনিষদ ৬/৮)।

গীতায় বলেছে,

বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র তুমিই; পিতামহ ব্রহ্মাও তুমি এবং ব্রহ্মার জনকও (প্রপিতামহ) তুমি। তোমাকে সহস্রবার নমস্কার করি, আবার পুনঃ পুনঃ তোমাকে নমস্কার করি। (গীতা, ১১/৩৯)

তোমাকে সম্মুখে নমস্কার করি, তোমাকে পশ্চাতে নমস্কার করি; হে সর্বস্বরূপ, সর্বত্রই তুমি - তোমাকে সকল দিকেই নমস্কার করি; অনন্ত তোমার বলবীর্য, অসীম তোমার পরাক্রম । তুমি সমস্ত ব্যাপিয়া রহিয়াছ, সুতরাং তুমিই সমস্ত । (গীতা, ১১/৪০)

গীতায় ১১ অধ্যায় ৩৯-৪০ নং শ্লোকে অর্জুন যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে বারবার নমস্কার সম্বোধন করেছেন। গীতায় কোথাও এই হরেকৃষ্ণ/রাধে রাধে বা জয়গুরু এরুপ কিছুই নেই।

শিব গীতা ৭/৩৭ তে ও নমস্কার এর উল্লেখ আছে।

"যোগ যেমন পরমাত্মার দর্শনের সাধন বা উপায়, নমস্কারাদিও অনুরূপ বলিয়া তাঁহাকে নমস্কার জানাই। তিনি কিরুপে?

তিনি দেব অর্থাত্‍ পরমাত্মার প্রকাশভাব। তিনি কোথায়? তিনি আছেন অগ্নিতে, জলে, তৃণ-লতাদিতে, অশ্বাথাদি বৃক্ষে, তিনি এই বিশ্বভুবনে অন্তর্যামিরুপে অণুপ্রবিষ্ট হইয়া আছেন।"

তাই যখন কাউকে নমস্কার জানানো হয় তখন মূলত সর্বজীবে অন্তর্যামী'রুপে অবস্থিত পরমাত্মাকেই প্রণতি নিবেদন করা হয়, কোন মনুষ্যদেহকে নয় । সুতরাং, নমস্কার সকলকেই জানানো যায়।

নমস্কার জানাতে হাত জোড় করতে হয় কেন?

দুই হাত জোড় মূলত অহমিকা ত্যাগ পূর্বক বিনয়ভাব প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয়।

সংস্কৃতিভেদে করজোড়ে কিছুটা বৈচিত্র্য দেখা যায় যেমন দেবতাদের উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করতে সাধকরা মাথার উপরে দু'হাত জোড় করে থাকেন। আবার কোন ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতে নমস্কার জানাতে বুকের বরাবর হাত জোড় করা হয় এবং একই সাথে পরমাত্মাকে প্রণতি ও আয়ুষ্মান (দীর্ঘায়ু কামনা) কে নির্দেশ করে।

শাস্ত্রসম্মত বৈদিক সভ্যতা ধারন করুন, মনুষ্য সৃষ্ট মতপথ কে পরিহার করে ঐক্যের পথ অনুসরন করুন।

এছাড়াও সনাতন আইন শাস্ত্র তথা বেদ বিহিত ধর্মই সনাতন। মনুসংহিতা ২/১৩ বলে বেদই সনাতন এর প্রামান্য শাস্ত্র এবং বেদ বিরুদ্ধ স্মৃতি হলে স্মৃতি পরিত্যাজ্য! ১২/৯৫
বিরুদ্ধতা কারী নাস্তিক। (মনু, ২/১১)

নমস্কার ইংরেজিতে করলে দাড়ায় With My Head And Heart I Salute The God In You.
অর্থাৎ— আপনার অন্তঃস্থ ঈশ্বরকে আমি অন্তর দিয়ে অনুভব করছি ও সম্মান প্রদর্শন স্বরূপ তার কাছে মাথা নত করে প্রণতি জ্ঞাপন করছি।
জয় মা ভারতী