tarun malakar's Album: Wall Photos

Photo 163 of 265 in Wall Photos

পাথরের সিংহাসন

#মুবারক আমার নাম, বাবা মা খুব শখ করে রেখেছেন নামটা। শুনেছি বহুদিন পর এসেছিলাম, তাই খুব খুশি হয়ে এই নাম রেখেছেন আমার।

মোটামুটি স্বচ্ছল সংসার আমাদের, বাবা যে মুঙ্গেরের বড় স্থপতি। বাবার হাতে জাদু আছে। পাথর যেন কথা বলে উঠে। সে হিন্দু ভগবান মূর্তি বল বা শিবলিঙ্গ, জলের কলসি হোক বা গেলাস, বাটি হোক বা থালা, মন্দিরের চূড়া হোক বা মসজিদের জাফরি, ফটকের সামনে নাম হোক বা দরজার চৌকাঠ, দরজা হোক বা জানালা, কাজ যে দেখবে সেই অবাক হয়ে থাকবে।
কত দূর দূর থেকে লোক আসে সেইসব জিনিস কিনতে দিল্লি বাংলা দক্ষিণ উত্তর পশ্চিম সবদিক থেকেই লোকজন এসে জিনিস নিয়ে যায়, বরাত ও দিয়ে যায় যার যেমন বায়না...

বেশ বড় আর সম্ভ্রান্ত ঘর আমাদের। কোন কিছুর অভাব নেই। দাদু ছিলেন ফৌজদার এখানে, দাদুর মৃত্যুর পর সব সম্পত্তি নিয়ে চলে যায় শাজাহান। ময়ূর সিংহাসন আর তাজমহল এর খরচ অনেক। নতুন ফৌজদার আসে। সেই সময়ের শুধু ঘরটাই রয়ে গেছে আমাদের, নিয়ে যেতে পারেনি বলে।

মা'ও আমার চলে গেছে, আমি তখন ছোট। মনে পড়ে মুখখানা। মা'র সব জিনিস সাজানো একটা ঘরে। শুনেছি এই ঘরেই মা থাকতেন আমায় নিয়ে।

বাবার সাথে মাঝে মাঝে পাথর আনতে যাই। চিনতে পারি এখন, কোন পাথর ফাঁপা কোন পাথর স্তর আছে, সব সরিয়ে বেছে নিতে হয় নিটোল পাথর। দুটা বড় ঘোড়া গাড়ি করে আনা হয় পাথর।
সেইসব পাথর সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে তবেই আমার ছুটি।
কয়েকজন কর্মচারী রয়েছে তারাই বাবার সহায়তা করে। আমি অত দেখিনা তবে মাঝে মাঝেই বাবা ডেকে দেখান কিভাবে ছেনি ধরতে হয়, কিভাবে হাতুড়ি মারতে হয়। কোন কোনে কতটা ধরলে কতটা মারলে কতটা পাথর কাটবে। যদিও আমি তেমন কিছু শিখে উঠতে পারিনি তখনও।

অস্ত্র চালনা শিখেছি মুঙ্গেরের বড় যোদ্ধার কাছে। বাবার ইচ্ছে আমি #শাজাহান এর সৈন্যদলে যোগ দি। কিন্তু আমার ইচ্ছে নেই একদম। করে কি হবে একদিন রাজার ইচ্ছে হবে সব নিয়ে নেবে আবার।

আমার নেশা মাছ ধরা, কয়েকজন বন্ধু রয়েছে তাদের সাথে নদীতে মাছ ধরেই কাটে সময়। সারাদিন ব্যস্ত থাকি এসবে, মাছের চার জোগাড় করতেই কেটে যায় সময় সারাদিন।

বাবা এসব দেখেশুনে বিরক্ত। কাজে মন নেই। সারাদিন নদীর পাড়ে বসে থাকিস... এই সব আর কি। এই নিয়ে ঘরে এলেই লেগে যায় তর্ক।
শেষে একদিন আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। তবে এতে আমি খুব খুশী, খুবই সুন্দরী আমার স্ত্রী। নাম পিরবাণু। পাশের শহরের বড় ঘরের মেয়ে। দেখতেও যেমন গুনও তেমন। সেলাই রান্না ছবি আঁকা ঘর গোছানো সবেতেই সে পারদর্শী।

এই কয়েক মাসে বুঝেছি আমরা একে অন্যকে খুবই ভালোবাসি।

কিন্তু মাছ ধরার নেশা আমি ছাড়তে পারিনি। বউ এর একটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ও রয়েছে। তাই আমি যেমন ছিলাম আছি তেমনি। তবে এখন আমি সকালে উঠে সময় দি বাবার সাথে পাথর কাটতে। এই কয়েকমাসে অনেক কিছু শিখেও গেছি।

গত বেশ কয়েকদিন ব্যস্ত ছিলাম পাথর আনতে গেছিলাম বাবা'র সাথে। একটা বেশ বড় পাথর এনেছি আমার পছন্দের। একটা বড় সিংহাসন বানাব। বাবা এটা খুব ভালো বানান। কত বড় বড় লোকের জন্য বাবা বানিয়ে দিয়েছেন। এবারে আমি বানাব বাবার জন্য।

পাথর টাকে নিয়ে এসে সামনে ফেলে রেখেছি আজ বেশ কদিন হল। একদম শুকিয়ে যাক তারপরে কাজ শুরু করব।
তাই আজ গেলাম মাছ ধরতে, কাল থেকে বসব সিংহাসনের কাজে, একেবারে শেষ করে তবেই আসব আবার মাছ ধরতে। তাই এবারে বসলাম গঙ্গা নদীর দুমুখের পাশে, এখানে নদীর পাশে সুজা বন্দর। যখন সুজা আগ্রা গেছিল এই বন্দর দিয়ে গেছিল, তাই নাম ওর নামেই। চারিদিকে সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশ।

সকাল সকাল এসেছি মাছ ধরতে, বন্ধুরাও রয়েছে সবাই। কিন্তু আজ ভাগ্য খারাপ। মাছ পড়ছে না তেমন। কদিন ছিলাম না, বন্ধুদের বলেছিলাম চারা তৈরি করতে। ওরা ঠিকমতো বানায় নি মনে হচ্ছে। এইসব ভাবছি আর অধৈর্য্য হয়ে উঠছি।
দূরে দেখতে পাচ্ছি আসছে কতগুলো বজরা। ওরা কাছে এলে জল নড়ে উঠবে মাছ গুলো ভয় পাবে চলে যাবে দূরে। ধুস। আরো বিরক্তি লাগছে।

দেখতে দেখতে এসে গেল বজরাগুলো। সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন কোন সম্ভ্রান্ত বড়লোক। দাঁড়ানোর ভঙ্গি টা উদ্ধত। ভাবলেশহীন ঔদ্ধত্বে ভরা মুখমন্ডল। বুঝলাম এই শাহজাদা #সুজা।
কিছুদিন আগেই ভাই #আওরঙ্গজেবের কাছে হেরেছে এখন আবার ফিরেছে মুঙ্গের।
জরাসন্ধের প্রাচীন দুর্গে এখন ওর বাস।

ফিরে এলাম সেদিন। কিন্তু না মন শান্ত হচ্ছে না। পরেরদিন সকালে উঠে বাবার সাথে কাজ শুরু করলাম। না মাছ ধরা থেকে উঠছেই না মন।
দুপুরে খাওয়া সেরে আবার গেলাম #গঙ্গা তীরে। এবারে অন্যদিকে বসলাম। না ওই দিকে আর নয়...

সন্ধ্যের মুখে পেছনদিকে এসে দাঁড়াল কয়েকজন ঘোড়ায়।
ওখানে দাঁড়িয়েই বলল- এই নোংরা নালীর নরকের পাপী কীট সরে যা ওখান থেকে।
খুব খারাপ লাগলো কিন্তু কোন উত্তর দিলাম না। #বড়সিঁ গুছিয়ে নিতে থাকলাম। আবার অত্যন্ত নোংরা একটা ভাষায় বলল। স্বর্গত মা'র নামে বলা গালিটা শুনেএবারে আর সামলাতে পারলাম না। আমিও বলে দিলাম- ভদ্র রক্ত না থাকলে শরীরে, ভাষা এমনি নোংরা বেরোয়।
এবারে সামনে এল একটা অনুচর। এসে বলল উনি শাহজাদা সুজা, সাবধানে কথা বল।
এবারে বলেই দিলাম- এমন শাহজাদা ভাই এর ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, সে কেমন শাহজাদা, যে নিরস্ত্র মানুষের উপরে আক্রোশ দেখায়।

শুনেই শাহজাদা সুজা ঘোড়া থেকে নেমে এসেই তরোয়াল নিয়ে আক্রমন করল। আমিও বড়সিঁ নিয়ে আক্রমন করলাম। তরোয়ালের খোঁচায় হাত কাটতেই আমি বড়সিঁ দিয়ে খোঁচা দিলাম ওর মুখে, খুব গভীর কেটে গেল মুখের একটা পাস শাহজাদা সুজার। এরপর সুজা আমার বুকে সোজা বসিয়ে দিল তরোয়াল। তরোয়াল বের করে নিতেই ঝলকে ঝলকে রক্ত বেরিয়ে এল সাথে কয়েক সেকেন্ডের তীব্র ব্যথা অনুভব হতে লাগল। পড়ে গেলাম, সুজা সেই শরীরে লাথি মেরে চলেছে। অনুচররা শান্ত করল সুজা'কে। ততক্ষনে এসে গেছে আমার বন্ধুরা আশেপাশে।

আমার শরীর ঝুলিয়ে নিয়ে চলেছে অনুচরেরা আমার ঘরের দিকে। বন্ধুরা চলেছে পথ দেখিয়ে। পেছনে সুজা আর অনুচরেরা। বাইরে শুকোতে দেওয়া পাথরটার উপরেই রাখল আমার শরীরটা।
বাবা এলেন আমার সামনে, বলতে চেষ্টা করলাম কিন্তু আওয়াজ বেরুচ্ছে না। পিরবাণু এসেছে ছুটে, আছড়ে পড়ছে আমার বুকে। সুজার নজর পিরবাণুর দিকে। বাবা চুপ। কিছু বলছে না। আমার খুব ঠান্ডা লাগছে। খুব ঠান্ডা। পিরবাণু'র স্পর্শ আর পাচ্ছি না। ঠান্ডা ঠান্ডা আরো ঠান্ডা।

এখন নেই কোন ব্যাথা কোন বেদনা।
আমি দাঁড়িয়ে এখন সবার সাথেই। দেখছি পাথরটা আবার ভিজে গেছে আমার রক্তে। পিরবাণু কেঁদে চলেছে আর বাবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সুজা লেহন করে চলেছে নজরে নজরে পিরবাণু কে।
অদ্ভুত এই রাজারা, এদের সবই ভোগ্য আর কিছুর কোন দাম নেই। না ভালোবাসা না অনুভূতি না প্রানের দাম। শুধু চাহিদা আরো ক্ষমতা আরো অর্থ।

সারারাত ধরে চলল আমার দেহের পারলৌকিক কাজ, ভোরে কবরস্থ হলাম আমি।

আমি এখন শুয়ে থাকি ওই পাথরটা'র উপরেই। রক্তবিন্দুগুলো বড়ই আরাম দেয় আমায়। বেশ ভালো লাগে। কিন্তু বাবা যে শুধুই কেঁদে চলেছেন পাথরটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই।
তার পরেরদিন এল এক অনুচর বাবার কাছে। বাবা তখন চুপচাপ বসেছিলেন পাথরের পাশে আর এক নজরে দেখে চলেছেন আমার রক্ত, এখন শুকিয়ে জমে গেছে পাথরের উপরে।
এক থলি সোনা হাতে দিয়ে বলল একটা সিংহাসন বানিয়ে দিতে হবে শাহজাদা সুজা'র জন্য। অর্থ দিয়ে ভুলাতে চায় বাবা'কে। বাবা চোখের জল সামলে বললেন- শাহজাদা'র ইচ্ছে যখন, বেশ বানিয়ে দেব সিংহাসন।
অনুচর চলে গেল কিন্তু বাবা ঘুরেও দেখলেন না সোনার থলে টাকে।

সেইদিন থেকেই বাবা শুরু করে দিলেন পাথরটা শুদ্ধির কাজ। যন্ত্র আঁকলেন সেদিন রাতে, আর দিলেন নিজের কয়েকফোঁটা রক্ত, ডাকলেন শয়তান'কে। নিজের আত্মাকে করে দিলেন শয়তানের কাছে বিক্রি। বিনিময়ে চাইলেন সমস্ত রাজাদের বিনাশ।

পরেরদিন থেকে শুরু করলেন সিংহাসনের কাজ। না কোন রক্ত মুছলেন না তিনি। চুপচাপ করে যেতে লাগলেন কাজ।

দুদিনেই অনেকটা তৈরি হল সিংহাসন। আবার এল সুজার লোকজন, বলল নিয়ে যাবে পিরবাণু কে রাজার হারেমে।
বাবা চুপচাপ মত দিলেন। অমত করলেও কিছু লাভ হত না।
পরেরদিন #পিরবাণু কে নিয়ে গেল।

এদিকে সিংহাসন তৈরি শেষ।
উপরে বাবা লিখে দিলেন...
তখৎ মুবারক
#খাজা #নজর #বোখারি কর্তৃক নির্মিত
মুঙ্গের 1052 সালের 27 শে শাবন

সেদিন রাতে সুজা বসে পান করলেন সিংহাসনে। পরেরদিন এল আওরঙ্গজেবের সেনা। সুজা চলল ঢাকা, সাথে সিংহাসন। এরপরে সুজার খবর কেউ জানেনা।
সিংহাসন গেল আওরঙ্গজেবের #সেনাপতির কাছে। সে বসে বসে স্বপ্ন দেখল আওরঙ্গজেব'কে সিংহাসন চ্যূত করার। কিছুদিন পরে মরল।
একে একে বসল অনেক রাজা সবাই মরল ভয়ানক মৃত্যু।
সবার শেষে মরল #সিরাজ উদ দৌলা
আর তারপরে #মীরজাফর।

তারপর দীর্ঘদিন এই সিংহাসন পড়েছিল মুর্শিদাবাদে। শেষে #লর্ড #কার্জন নিয়ে আসে #ভিক্টরিয়া #মেমোরিয়ালে।
ওখানেই এখনো রাখা আছে এই সিংহাসন যার অন্য নাম #তখৎ #মোবারক।

সিংহাসন তৈরির কয়েকদিন পরে বাবা আত্মহত্যা করেন। আমি এখনো শুয়ে থাকি এই পাথরে। পাথর তো নয় এখন সিংহাসন। হ্যাঁ আমার বাবাও আসেন আমার কাছে যেদিন আমার মৃত্যু হয়েছিল, যেদিন আমার রক্তে রাঙা হয়েছিল এই পাথর। সেদিন আমরা হই একসাথে আবার। যন্ত্রনা হয় খুব, রক্তে ভেসে যায় আর বাবা মুছতে থাকেন। কিন্তু রক্ত বেরোতেই থাকে।
তাই তো বছরে একদিন এই তখৎ মোবারকের থেকে ফোঁটা ফোঁটা #রক্ত বেরিয়ে আসে, আজও।

✍️ পৃথ্বীশ সেন