Rastrabadi Rama's Album: Wall Photos

Photo 2 of 6 in Wall Photos

*শিবাজী মহারাজের জীবনী ও বীরত্বগাথা*

*যাত্রা হল শুরু*
শিবাজীর এখন থেকে এক নতুন পর্যায়ের জীবন আরম্ভ হল। তিনি এখন দাদাজী পন্তের সাহায্য ছাড়াই একজন বিশ্বস্ত রক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে গ্ৰাম-গ্রামাঞ্চলে পরিভ্রমণ শুরু করলেন। ক্রমে নিজের জাগীরের সীমা ছাড়িয়ে নিজ প্রভাব ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করার কাজে মনোনিবেশ করলেন। মাবলের গ্রামগুলি থেকে শিবাজী কয়েকজন বীর ও কর্মঠ যুবককে সংগ্রহ করলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য― *তানাজি মালুসরে ও তার ভাই সূর্যাজী, সূর্যাজী কাকড়ে, ত্র্যম্বক সোনদেব, দেশপাণ্ডে বংশের নারায়ণ, চিমনাজী ও বালাজী এবং নরসিংহ গুপ্তে প্রমুখ*। শিবাজীর অনুগামীরূপে স্বরাজের জন্য প্রাণ দিতেও তৎপর এই যুবকেরা শিবাজীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলেন।

স্বরাজ প্রতিষ্ঠার যে পরিকল্পনা তাঁর মনের মধ্যে দানা বেঁধে উঠছিল, তার সফল রূপায়ণের জন্য অরণ্য-পর্বতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলির সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের প্রয়োজন ছিল। *শিবাজী জানতেন, তিনি যে কাজে সংকল্প গ্রহণ করেছেন তাকে কার্যকর করার পথ অতিশয় কণ্টকাকীর্ণ*। একাধিক প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। সুতরাং এই ভয়ঙ্কর সহ্যাদ্রির পর্বতমালা, গুহা-কন্দর, নিবিড় অরণ্যের দুর্গম শ্বাপদ-সঙ্কুল পথ নদীনালা-নির্ঝারণী প্রভৃতি সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জেনে নিতে হবে এবং তাঁর বিশ্বস্ত দুঃসাহসী বীর বন্ধুদের‌ও তার সঙ্গে পরিচিত করতে হবে, অরণ্য-পর্বত ও গ্রামাঞ্চলের মানুষদের বন্ধুত্ব, আস্থা ও সহযোগিতা অর্জন করতে হবে, যাতে স্বরাজের সকল প্রয়োজনে, সব রকম বিপদে-আপদে আপামর জনসাধারণের অকুণ্ঠ সাহায্য লাভ করা যায়। শিবাজী অতি দরিদ্র, নিরক্ষর চাষী বনবাসী ও গিরিজনদের সঙ্গে একান্ত আপনজনের মত মিশতেন, তাদের কষ্ঠ লাঘব করার জন্য সবরকম ব্যবস্থা অকুস্থলেই গ্রহণ করতেন। এভাবে তিনি হাজার হাজার মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন।

শিবাজী তাঁর নুতন বন্ধুদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার‌ও ব্যবস্থা শুরু করে দিয়েছিলেন, যাতে তাঁরা সর্ব প্রকারে সফল যোদ্ধা ও নীতিনিষ্ঠ কুশল প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম হয়ে ওঠেন। গুরুর কাছে পাওয়া শারীরিক ও সামরিক শিক্ষা এবার তিনি দিতে শুরু করলেন তাঁর বীর বন্ধুদের। গ্রামের পথে যেতে-যেতে মুসলমানদের অসহিষ্ণুতার নিদর্শন-স্বরূপ ভগ্ন দেবালয়গুলি দেখে সকলেরই রক্ত গরম হয়ে উঠত। এসব ধ্বংসস্তূপের কাছে বসে শিবাজী তাঁদের মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করতেন ।

দু-একজন অতি উৎসাহী যুবক খাপ থেকে তলোয়ার বের করে বলে উঠত ― "রাজে ! আপনি আদেশ দিন, এখনই গিয়ে এই মন্দির ধ্বংসকারীদের মাথা কেটে এনে আপনার কাছে হাজির করি।" শিবাজী তখন সেই ছোটবেলার বিজাপুর দরবার থেকে ফিরে আসার সময় মায়ের শিক্ষার কথা মনে পড়ল। সেই কথাটিই তিনি তাঁর এই মাথাগরম সহকর্মীদের বুঝিয়ে সহকর্মীদের বুঝিয়ে বলতেন, ― *"দেখ ভাই, রাগের মাথায় হঠাৎ কিছু করে ফেলার মধ্যে কোন বাহাদুরি নেই। একটা নয়, ওরা অসংখ্য মন্দির ধ্বংস করেছে, গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে দিয়েছে, কত নারীকে স্বামীহারা ও সন্তানহারা করেছে। অসংখ্য মানুষকে গৃহহীন করেছে, কত সহস্র সংসারকে ধ্বংস করেছে। সুতরাং আমাদের এমন ভেবে-চিন্তে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করতে কাজ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কখন‌ও কোথাও এরকম না ঘটে। সেই কারণেই এসব বিদেশী বিধর্মী শাসকদের শাসন থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে, হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে*। তার জন্য গ্রামে-গ্রামে গিয়ে, বনাঞ্চলে― পর্বতঞ্চলে ছোট-বড় সকলকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে হবে। তোমাদের এই রাগ মনের মধ্যে পুষে রাখ। যখন উপযুক্ত সময় আসবে, তখন ঐ রাগের সদ্ব্যবহার সকলে এক সঙ্গে মিলে করতে হবে― শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়ে।"
এইসব উৎসাহী বন্ধুদের নিয়ে শিবাজী পুনার দক্ষিণ দিকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে রায়রায়েশ্বর মন্দিরে উপস্থিত হলেন, সেখানে সারারাত ধরে চলে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং এক অভূতপূর্ব উৎসাহ-উদ্দীপনায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এইসব বীর যুবকদের মুখ । ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী নদীতে স্নান করে এসে রায়রায়েশ্বর মহাদেবের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সর্বাগ্রে শিবাজী শিবের পূজা করেন । এরপর প্রত্যেক যুবক বিল্বপত্র হাতে নিয়ে পরম ভক্তি সহকারে ভগবানের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন, ব্যক্তিগত পূজা শেষ হলে শিবাজীর নেতৃত্বে সকলে, সমবেতভাবে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা এবং দেশ ও ধর্ম রক্ষার কাজে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন ।
শিবাজী তাঁর যুবক বন্ধুদের নিয়ে সর্বত্র পরিভ্রমণের সময়ে কাছাকাছি দুর্গগুলিও পরিদর্শন করতেন, যেগুলি ঐ সময়ে আদিলশাহীর অধীনে ছিল। কোন দূর্গের সুবেদার তথা দুর্গরক্ষক কে, কোন্ দূর্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কী রকম, কোথায় কতজন প্রহরী বা রক্ষী নিযুক্ত আছে, দুর্গে প্রবেশের প্রধান দ্বার ও গুপ্ত পথ কোথায়, দুর্গের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র রসদের ভান্ডার কোথায়, দুর্গরক্ষকের মধ্যে কী কী দুর্বলতা আছে ― ইত্যাদির সব রকম তথ্য তিনি এই সমস্ত অভিযানের সময় খুব যত্ন সহকারে সংগ্রহ করতেন।