Avijit Kar's Album: Wall Photos

Photo 2 of 2 in Wall Photos

দেশভাগ নিয়ে নমঃশূদ্র বা মতুয়া সম্প্রদায়ের ইতিহাস বলতে গেলে আমরা বুঝে হোক বা না বুঝে যার নাম সব থেকে বেশি উচ্চারণ করি‚ যার কথা সব থেকে বেশি ছড়াই সে হলো যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। হ্যাঁ পাকিস্তানকে সাপোর্ট করার মতো ওনার ঐতিহাসিক ভুল ( বা অন্যায়)‚ তারপর পাকিস্তানে মন্ত্রী হওয়া‚ আবার জেহাদীদের তাড়া খেয়ে নিজের অনুগামী‚ যারা তাকে বিশ্বাস করে পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিলো তাদের ফেলে রেখে ভারতে পালিয়ে আসা‚ এগুলো অবশ্যই মানুষকে জানানো উচিৎ দলিত মুসলিম ঐক্যের মিথ্যে টোপ সবার সামনে ফাঁস করে দেওয়ার জন্য।

কিন্তু এরই সাথে যে মানুষটার নাম আরো অনেক বেশি করে উচ্চারিত হওয়া উচিৎ ছিলো তিনি হলেন শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের সুযোগ্য নাতি ব্যারিস্টার প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর।

জিন্নাহর কথায় ভুলে যোগেন মন্ডল তখন মুসলিম লীগ প্রেমে উদ্বাহু হয়ে নাচছে। পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন‍্য একটি সংবিধান সভা গঠিত হয়েছিল। হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্যে টোপ হিসাবে সেই সভার প্রথম বৈঠকেই জিন্না সভাপতিত্ব করার ভার দিলেন যোগেন মন্ডলকে। যোগেন মন্ডল এত খুশি হলেন যে জিন্নার প্রশংসা করে তাঁকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট নেতা বলে অভিবাদন করে বসলেন। সাথে নিজের ব্যক্তিত্ব ব্যবহার করে নমঃশূদ্র দের পাকিস্তানের সমর্থক হওয়ার জন্য পরামর্শ (বা নির্দেশ ) তো ছিলোই। যোগেন মন্ডলের সমর্থক আর জেহাদীদের যৌথ হুঙ্কার উঠলো-

"দলিত মুসলিম ভাই ভাই,
বর্ণহিন্দুর রক্ত চাই।"

কিন্তু প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর ঠিকই বুঝেছিলেন যে
ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়েই থাকতে বাধ্য হবে। ফলে তিনি পাকিস্তান ভেঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ তৈরীর দাবিতে শ্যামাপ্রসাদের সাথে এক সুরে সরব হয়ে ওঠেন। মতুয়াদের আহ্বান জানান তাঁর সঙ্গে দেশত‍্যাগ করে ভারতে চলে আসার জন্য। স্বজাতির উদ্দেশ্যে তিনি ভুল পথে না যাওয়ার আহ্বান জানালেন এই বলে -

“....মতুয়াগণ শিখ জাতির ন্যায় কর্মী এবং বীর্য্যবান সাধক হউক। শিখেরা যেমন এক কালে উত্তর ভারতকে রক্ষা করিয়াছিল, মতুয়াদিগকেও সেইরূপ বর্তমান দুঃখী ভারতকে রক্ষা করিতে হইবে ......।”
“.....ইহা বীর্য্যবানের ধর্ম। মনে রাখিও তোমরা বীর্য্যবান, কাপুরুষ নও । হিন্দুকে রক্ষা করিতে তোমরাই সমর্থ । হিন্দু ভারতকে রক্ষা করিতে তোমরাই সমর্থ। হিন্দু ভারতকে রক্ষা করিবার গৌরব তোমাদিগকেই অর্জন করিতে হইবে....।
......শ্রী শ্রী প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর।
মহাসঙ্ঘাধিপতি, মতুয়া মহাসংঘ
পৃষ্ঠা:১৭৬

হিন্দুদের মধ্যে ভ্রাতৃবিরোধ মেটানোর উদ্দেশ্যে আরও বললেন -

"বাঙালি হিন্দুর আজ বড়ো দুর্দিন। সর্বসাধারণ হিন্দুর অকপট মিলন ভিন্ন হিন্দুর রক্ষার উপায় নেই। পূর্বের দুষ্কৃতী মনে করিয়া ভাইয়ের ওপর ভাইয়ের অভিমান করা আর চলে না। তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ সাগরের বুকে ভাই ভাইয়ে বিবাদ করিয়া ডুবিয়া মরিও না।আগে সমাজ তরণীকে রক্ষা কর,পরে বিবাদের যথেষ্ট অবকাশ পাইবে।"
শ্রী শ্রী প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর।
মহাসঙ্ঘাধিপতি,
মতুয়া মহাসংঘ
আত্মচরিত বা পূর্বস্মৃতি(প্রথম সংস্করণ)
পৃষ্ঠা : ১৭৮

সবাই যদিও এল না তাঁর সঙ্গে। ভ্রাতৃবিরোধের অন্ধ ক্রোধ আর ইসলামী পাকিস্তানে ব্রাহ্মন্যবাদী অপমান থেকে মুক্ত হওয়ার সুখস্বপ্ন তাদের বাধ্য করলো যোগেন মন্ডলের উপরেই আস্থা রাখতে।

কিন্তু তবুও অনেকেই এলো। এপারে এসে বনগাঁর কাছে গাইঘাটায় আশ্রয় নিলেন প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সম্পূর্ণ বাস্তুহারা নমঃশূদ্ররা সেখানেই গড়ে তুলল তাদের নতুন প্রাণকেন্দ্র। নাম হল ঠাকুরনগর। শুরু হলো বারুনী মেলা। এখানে তাঁর
তৈরী বাড়ির নাম রেখেছন --"Exile "বা নির্বাসন । অর্থাৎ পূর্ব বাংলাই তার তাঁর জন্ম স্থান , ঠাকুর নগর তাঁর নির্বাসন মাত্র। ( হয়তো ঠিক যেমন আমরা সবসময় পশ্চিমবঙ্গ বলতে বলি‚ শুধু বঙ্গ বা বাংলা না। যাতে মনে থাকে যে পূর্ব দিকে একটি দখলীকৃত ভূমি আছে )

ওদিকে যোগেন মন্ডলের কি হলো? তার ভরসায় বিরাট সংখ‍্যক নমঃশূদ্র থেকে গেলো পাকিস্তানেই। ১৯৫০ সাল থেকেই বাংলাদেশে নমঃশূদ্রের উপর নেমে এল ভয়ঙ্কর জেহাদী অত‍্যাচার। পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে নমঃশূদ্র বিরোধী স্লোগান উঠলো -

"জিন্না আনলো পাকিস্তান‚ গান্ধী গেল মারা ,
হিন্দু গেল হিন্দুস্থান‚ চাড়াল কে এবার সরা ! "

যোগেন মন্ডল নিজের চোখে পরিস্থিতি দেখতে বেরিয়ে পড়লেন। সবকিছু দেখলেন‚ বুঝলেনও হয়তো।
আইনমন্ত্রী হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে কৈফিয়তও তলব করলেন। কিন্তু কেউ জবাবদিহি করল না, এমনকি নিজের পদমর্যাদার ন‍্যূনতম সম্মানটুকুও পেলেন না।

তবুও পদের মোহ তখনও তাকে এতটাই অন্ধ করে রেখেছিলো যে তখনও তিনি জায়গায় জায়গায় সভা করে নমঃশূদ্রদের অভয় দিতে লাগলেন আর বললেন, তোমরা কেউ দেশ ছেড়োনা, এখানেই থাকো, আমরা এদেশেই থাকবো। আর ইতিহাসের কি অদ্ভুত লীলা‚ এইরকমই এক সভা করার পর রাতের অন্ধকারে তাকে নিজের প্রাণ হাতে করে লুকিয়ে ভারতে পালিয়ে আসতে হলো নিজের মেয়ে ও বৌ-এর ইজ্জত বাঁচাতে। ছেড়ে আসতে হলো সেই পাকিস্তান‚ যার জন্যে তিনি এত লড়াই করেছেন। আর তারই সঙ্গে ছেড়ে আসলেন কয়েক লক্ষ নমশূদ্রদের ভয়ঙ্কর মৃত্যুর মুখে‚ যারা তাকে বিশ্বাস করে তারই ভরসায় পাকিস্তানে রয়ে গিয়েছিলো!

সত্যি বলতে কি আমিও তেমন কিছুই জানতাম না এই মহাপুরুষের সম্পর্কে। শান্তনু ঠাকুরের কেউ একটা হন‚ শ্যামাপ্রসাদের সমর্থক ছিলেন‚ এইটুকুই শুধু জানতাম। কাল রাতে নেটে ঘাটাঘাটি করিতে গিয়ে অবশেষে ডিটেইলস জানতে পারলাম ওনার সম্পর্কে।

যোগেন মন্ডলের কাহিনী তো আমরা অবশ্যই প্রচার করবো। সাথে প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের কথাও প্রচার করা উচিত। সবসময় নেতিবাচক কেন? ইতিবাচক ভাবনাচিন্তাও আসুক আমাদের মনে। তাইনা?

© Souvik Dutta