SOMJYOTI NANDI's Album: Wall Photos

Photo 2 of 3 in Wall Photos

#প্রাচীন_কলকাতার_কথা_কালীঘাটের_সেকাল_একাল

শক্তিপীঠ বা সতীপীঠ নিয়ে কিছু বলতে যাওয়া বেশ বিপদজনক কারণ এত মানুষের সেন্টিমেন্ট এবং অন্ধ বিশ্বাস এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে, যুক্তির কথা কেউ মানতেও চাইবেনা, শুনতেও চাইবেনা, উল্টে হয়ত তেড়ে আসবে অনেকে। তবুও সাধারণ বুদ্ধিতে বলি, এসব পীঠস্থানগুলি শুধুই লোকবিশ্বাসের অঙ্গ, কোন ঐতিহাসিক সত্যতা এরমধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমন পীঠের উৎপত্তি শুরু হয়েছে সত্যযুগে দক্ষরাজার যজ্ঞ থেকে। এতো কেবল লোককথা আর বিশ্বাস, এর সপক্ষে কোন ঐতিহাসিক সত্য প্রমান দেখানো যাবে কি ?

আবার একটা ব্যাপার দেখুন- পীঠের সংখ্যা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। পীঠ নির্ণয় তন্ত্র বলছে, সতী পীঠের সংখ্যা ৫১ টি। একে তো পীঠমালা বা পীঠনির্ণয় তন্ত্র বয়সে অর্বাচীন, আবার দেখছি শিব চরিত মতে সংখ্যাটি হচ্ছে ৫১ পীঠ + ২৬ উপপীঠ। কুব্জিকাতন্ত্র মতে পীঠের সংখ্যা ৪২, জ্ঞানার্বতন্ত্র গ্রন্থে সংখ্যাটি দেখছি ৫০, আদি শংকরাচার্য্য লিখিত অষ্টাদশ শক্তিপীঠ স্তোত্রম কিন্তু বলছে কেবলমাত্র ১৮ টি মহাশক্তিপীঠ রয়েছে যাঁর মধ্যে কালীঘাটের নামই নেই। আবার অন্যদিকে দেবী ভাগবত, শিব পুরান, কালিকা পুরান মতে ৪ টি মাত্র আদি শক্তিপীঠ রয়েছে যার অন্যতম হচ্ছে কালীঘাট যেখানে সতীর মুখখন্ড পতিত হয়। অবশ্য ৫১ সতী পীঠের তালিকাতে রয়েছে কালীঘাটের নাম, তবে এই মতে সতীর ডান পায়ের আঙ্গুলি পতিত হয়েছিল এখানে। বর্তমান কালীঘাটের মন্দিরে প্রস্তরখন্ড নির্মিত মায়ের মুখমন্ডল এবং পদাঙ্গুলি নাকি রাখা আছে। নাকি বললাম এই কারণে, প্রায় ৬ কেজি ওজনের পাথরের আঙ্গুল ভক্তদের দর্শন করতে দেওয়া হয় না। শোনা যায় এই প্রস্তরখন্ডটির অধিকার নিয়ে সেবায়েতদের মধ্যে মনোমালিন্যের সময় এটি নাকি দ্বিখন্ডিত হয়ে গেছে। বর্তমানে এটিকে একটি রৌপ্য সিন্দুকে ভরে রাখা হয়েছে।কালীর ঘাট থেকে কালক্রমে কালীঘাট। অর্থাৎ মাকালী বহুদিন আগে থেকেই এখানে অবস্থান করতেন, তাই এটি ছিল মাকালীর পীঠ বা পীঠস্থান । পীঠের পাশ দিয়ে বয়ে যেত গঙ্গা এবং নৌকা ও বজরা থেকে কালীর ঘাটে নেমে যেতে হত মাকে পুজো দিতে।গঙ্গার উপরে কালীর ঘাটকে ভক্তদের জন্য বাঁধিয়ে দেন আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী হুজুরিমল ১৭৭০-৭১ সালে। এই নিয়েও আছে এক কাহিনী, হুজুরিমল নৌকা নিয়ে যাচ্ছেন বেনারস, কিন্তু নৌকার মুখ ঘুরে গিয়ে লাগল কালীর ঘাটে। ইনার নামেই নেবুতলায় রয়েছে হুজুরিমল লেন । এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই আর্মানি সাহেবই কিন্তু আর্মেনিয়ান ঘাটও নির্মাণ করেন।

কালীঘাটের বর্তমান মন্দির নির্মাণ হয় ১৮০৯ সালে, বড়িষার জমিদার সন্তোষ রায় চৌধুরী এবং তাঁর উত্তরসূরিদের হাতে। এ নিয়ে পরে আসছি।মানসিংহের হাতে প্রতাপাদিত্য পরাজিত হলে মানসিংহের গুরুদেব কামদেব ব্রহ্মচারীর পুত্র লক্ষীকান্ত হলেন বাংলার এক বিশাল অঞ্চলের জায়গীরদার। মুর্শীদকুলি খান সুবে বাংলাকে ভাগ করেন অনেকগুলি পরগনা এবং ১৩ টি চাকলায়। লক্ষীকান্তর নাতি কেশবকে দেওয়া হয়- রায়চৌধুরী উপাধি এবং দক্ষিণ চাকলায় রাজস্ব আদায়ের ভার। কেশব রায়ের চতুর্থ পুত্র ছিলেন সন্তোষ রায়( ১৭১০-১৭৯৯)।সন্তোষ রায় ছিলেন তাঁর সময়ে এক প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তি এবং বাবু কালচারের যুগে অন্যতম হিন্দুকুল চূড়ামনি। কালীঘাটের কালীমূর্তি আবিস্কার করা থেকে, বর্তমান মন্দির নির্মাণ, সব কিছুর সঙ্গেই উনার নাম জড়িয়ে রয়েছে।

এবার আসা যাক পুরান কলকাতার এক বিখ্যাত ঘটনা প্রসঙ্গে।
বাবু কলকাতার শোভাবাজারে তখন বাসা ছিল কলকাতা শহরের দুই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী কোটিপতি লোকের- রাজা নবকৃষ্ণ দেব এবং মহাজনী কারবারি চূড়ামনি দত্তর। পয়সার দেমাকে দুজনেরই মাটিতে পা পড়েনা। দুজনেই প্রাণপনে চেষ্টা করে চলে অন্যকে হেও করার। নবকৃষ্ণের সঙ্গে চূড়ামনি দত্তের মামলা মোকদ্দমা প্রায় লেগেই থাকত, একবার তো প্রিভি কাউন্সিল অবধি মামলা চলেছিল, যদিও শেষ অবধি চূড়ামনি সেই মামলায় জয়লাভ করেছিলেন।

এতদূর অবধি তো ঠিকই ছিল, কারণ দুজনেই বাঙালির নিজস্ব সদ গুণাবলী তে ভরপুর ছিলেন। কিন্তু বিপদ ঘটল চূড়ামনির পুত্র কালীপ্রসাদ দত্তকে নিয়ে, তিনি ছিলেন বাবু কালচারের যথার্থ উত্তরসূরি। নিজের ঘরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন সবকিছু ত্যাগ করে আনারা বেগম নামক এক মুসলিম উপপত্নীকে নিয়ে থাকতেন তাঁর বেলেঘাটার বাগানবাড়িতে। এমনকি এই বাড়িটি অবধি তিনি আনারা বেগমের নামে লিখে দেন।

সেকালে হিন্দু সমাজে অদ্ভুত সব নিয়ম চালু ছিল। কোন ব্যক্তি যদি নিজবাটিতে ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যেতেন তবে ধরা হত এরকম মৃত্যুতে অনেক দোষ হয় । অন্যদিকে বর্তমানে নৃশংস বলে মনে হলেও সেযুগে গঙ্গাতীরে অন্তর্জলি যাত্রা করে যদি কারো মৃত্যু হত, তবে ধরা হত যে মৃত ব্যক্তির আত্মা সিধে স্বর্গারোহন করেছে। ১৭৯৭ সালের ২২ শে নভেম্বরে নিজঘরে ঘুমের মধ্যে নবকৃষ্ণের মৃত্যু ঘটে। চূড়ামনির ও তখন প্রায় যায় যায় অবস্থা। চতুর চূড়ামনি এই অবস্থার সদব্যবহার করতে উঠে পড়ে লাগলেন, অশক্ত শরীরেও অন্তর্জলি যাত্রার বন্দোবস্ত করলেন। নবকৃষ্ণের বাড়ির সামনে ঢুলী আর কীর্তন গায়কেরা চিৎকার করে গান শুরু করল-
” আয়রে আয় নগরবাসী, দেখবি যদি আয়।
জগৎ জিনিয়া চূড়া যম জিনিতে যায় ।।
যম জিনিতে যায়রে চূড়া, যম জিনিতে যায় ।
জপ-তপ কর, কিন্তু মরিতে জানিলে হয়।

নবকৃষ্ণের বাড়ির সামনে শয়ে শয়ে লোক তালি দিয়ে গানের সঙ্গে সঙ্গত করছে, স্বভাবতই নবকৃষ্ণের বাড়ির লোকেরা মৃত্যু নিয়ে এই লাঞ্ছনা এবং অপমান ব্যাপারটা ভালো ভাবে নেয়নি। আবার সত্যি সত্যি কয়েকদিনের মধ্যে চূড়ামনি গঙ্গা তীরেই গঙ্গা প্রাপ্ত হলেন।

নবকৃষ্ণ ছিলেন হিন্দু কুলপতি, তাঁর পক্ষের ব্রাহ্মণরা চূড়ামনির শ্রাদ্ধ করতে অস্বীকার করেন- অজুহাত দেখান যে চূড়ামনির পুত্র কালীপ্রসাদ ম্লেচ্ছ। আশ্চর্য লাগে ভেবে যে, নবকৃষ্ণের ব্যাটা রাজকৃষ্ণও কিন্তু এক মুসলমান বাঈজিকে উপপত্নী রেখেছিলেন, তাহলে এক যাত্রায় পৃথক ফল কি করে হয়? যদিও কালীপ্রসাদ বাবার মৃত্যুর পরে হিন্দুমতে প্রায়শ্চিত্ত করেন এবং মুসলমানি বিবিকে ত্যাগ করেন( আনোরা বেগম তখন মুন্সী বাজারের মালিক মুনশী আমিরকে বিয়ে করেন ), তবুও বাবার শ্রাদ্ধ করার ব্রাহ্মণ না পেলে, রামদুলাল সরকারের মধ্যস্ততায় সন্তোষ রায় মহাশয় প্রায় হাজার খানেক ব্রাহ্মন নিয়ে শ্রাদ্ধকর্ম করতে উপস্থিত হন এবং সন্তোষ রায়ের অনুরোধেই বরিশার অভয়চরণ ঘোষ তাঁর ৫ বছরের কন্যা পদ্মমনিকে ছেলে সাজিয়ে সরশুনার ঘোষ বংশের প্রতিনিধি হিসেবে শ্রাদ্ধের দিন পাঠান। এরপরে শ্রাদ্ধকার্য সব শান্তিতে সম্পন্ন হয়, কালীপ্রসাদ আবার জাতে ওঠেন । কৃতজ্ঞ কালীপ্রসাদ সন্তোষ রায়কে ২৫ হাজার টাকা দেন কোন সৎকার্যের জন্য । এই টাকা এবং সঙ্গে আরো ৫ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা হয় কালীঘাটের বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণের কাজ। সন্তোষ রায়ের হাতেই বর্তমান মন্দির নির্মাণ শুরু হলেও, তাঁর অবর্তমানে ১৮০৯ সালে মন্দির নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন তাঁর পুত্র রামদুলাল এবং ভ্রাতুষ্পুত্র রাজীবলোচন।

এতো গেল মন্দির নির্মাণের গল্প। এরপরে আসি মা কালী আর পায়ের আঙুলের কথায়।

কালীঘাটের মা কালী বা সতীর পদাঙ্গুল উদ্ধারের কাহিনী নিয়ে অসংখ্য গল্প কথা প্রচলিত আছে, বহু সাধক এবং বড় মানুষদের নিয়ে। এর মধ্যে রয়েছে আত্মারাম ও ব্রহ্মানন্দ নামক একজোড়া সাধকের কথা। ব্রহ্মানন্দ নামক এক সাধক নীলগিরি পর্বতের একটি শিলাখন্ড কে মা- কালিকা রূপে নাকি পুজো করতেন, পরে আত্মারাম নামক এক বাঙালি সাধুর পরামর্শে ইনি আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে এই মূর্তিটি কালীঘাটের মধ্যে ব্রহ্মার ঢিবি নামক জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেন।

আবার একটি মত হচ্ছে বহু বছর আগে পুরান পোস্তার কাছেই ছিল আদি কালীঘাটের মন্দির। পরে মন্দিরটি ভেঙে যায় এবং জায়গাটির নাম বদলে পোস্তার হাট হয়ে যায়।এরকম মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, দশনামী সন্যাসী জঙ্গলগিরি চৌরঙ্গী ইত্যাদি বহু কাহিনী জুড়ে আছে মাতৃমূর্তি উদ্ধারের সঙ্গে। জঙ্গলগিরির এক শিষ্যের কাছ থেকেই নাকি মাকে নিয়ে এসে বর্তমান মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন কেশব রায়চৌধুরী বা সন্তোষ রায়।

সব গল্পের সারমর্ম- অমুক সাধক বা অমুক রাজা বা বড় মানুষ কালীঘাটের মায়ের মূর্তি এবং পদাঙ্গুল খুঁজে পান, কিন্তু প্রতিটা ঘটনাই গল্প ছাড়া কিছু নয়, কারণ এঁদের বর্ণিত মায়ের মুখ মন্ডল উদ্ধারের কাহিনীর বহু আগে থেকেই মঙ্গলকাব্য গুলিতে কালীঘাটের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথমে আসি বিপ্রদাস পিপলাই এর কথায়। তিনি তাঁর ‘মনসাবিজয়’ কাব্য রচনা করেন ১৪৯৫ সালে। এই কাব্যেও কালীঘাটের নামোল্লেখ রয়েছে এরূপ-
” কালীঘাটে চাঁদো রাজা কালিকা পূজিয়া/ চূড়াঘাট বাহি যায় জয়ধ্বনি দিয়া।”

এর পরে যাচ্ছি কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাছে ( আনুমানিক ১৫৪০-১৬০০ )।
বাংলায় সম্রাট আকবরের দুই কর্মচারী ডিহিদার মামুদ শরীফ এবং রায়জাদা উজীরের অত্যাচারে, ১৫৫৭ সালে সাত পুরুষের ভিটে দামুন্যা গ্রাম ছেড়ে, প্রাণ হাতে নিয়ে মুকুন্দরাম চলে আসেন মেদিনীপুরের আরত্না গ্রামের জমিদার বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয়ে। তাঁর পুত্রের গৃহশিক্ষকের কাজ পান। তাঁর রচিত ” চন্ডীমঙ্গল কাব্যে” কালীঘাটের উল্লেখ আছে দেখতে পাবেন-
” বালুঘাটা এড়াইল বেনের নন্দন / কালীঘাটে গিয়া ডিঙ্গা দিল দরশন।”
এমন কি ক্ষেমানন্দের “মনসার ভাসানে” লেখা হয়েছে-” কালীঘাটে কালীবন্ধ বড়াতে বেতাই।”
আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতে কালীঘাটের উল্লেখ করা হয়েছে “কালীকোটা” নামে।

কালীঘাটের কালী মূর্তি উদ্ধার নিয়ে যতজনের নাম জড়িয়ে আছে, প্রত্যেকেই বিপ্রদাস পিপলাই বা মুকুন্দরামের পরবর্তী কালের লোক, তাই এঁদের দ্বারা মূর্তি উদ্ধারকাহিনী ধোপে টেঁঁকেনা।
তবে মন্দির প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে যেহেতু ঐতিহাসিক ভাবে বরিশার সন্তোষ রায় যুক্ত ছিলেন এবং তাঁর জন্ম ১৭১০ সালে তাই রাধারমণ বাবুর উক্তি প্রাণিধানযোগ্য।” কাজেই এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়না, কালীঘাটের বর্তমান কালীমূর্তি সন্তোষ রায়ের আমলে নতুন করে নির্মিত, প্রতিষ্ঠিত হয়নি।”

এবারে আসি মায়ের বর্তমান মুখমন্ডল এবং ভক্তদের দান- সামগ্রীর কথায়।

রাজা নবকৃষ্ণ ১৭৬৫ সালে সোনার মুণ্ডমালা দান করেছিলেন। সঙ্গে লক্ষাধিক টাকাও দান করেছিলেন তিনি।
আবার দেখতে পাচ্ছি ১৮২২ সালের মাঘ মাসের শেষে ওই একই বাড়ির তৎকালীন রাজা গোপীমোহন দেব এক এলাহী শোভাযাত্রা সহযোগে, মন্দিরে পৌঁছন , মায়ের মূর্তিকে সোনায় মুড়িয়ে দিতে। কি কি ছিল সেদিন মায়ের স্বর্ণালংকার দেখে নিন- চারটি সোনার হাত, পৈঁঁছা আর বাউটি – চার ছড়া আর চার গাছা, বিজটা- দুটি, মায়ের হাতে ঝোলান সোনার মুন্ডু, রূপোর খাঁড়া , জড়োয়ার অলঙ্কার ইত্যাদি। এখানে মজা হচ্ছে, বহু আগে খিদিরপুরের জনৈক ভক্ত জয়নারায়ন ঘোষাল প্রথমে চারটি রূপোর হাত, দুটি সোনার চোখ দান করেন, এর পরে কালীচরণ মল্লিক দেন ৪ টি সোনা বাঁধানো হাত। কালীঘাট মন্দিরের দানের নিয়ম হচ্ছে, কোন ভক্ত যদি বেশি দামের কোন অলঙ্কার দেন, তাহলে কম দামি অলঙ্কারটি পান পুরানো যজমানের সেবায়েত। কাজেই মায়ের অলঙ্কারের তালিকায় এখন থাকার কথা ৪ টি করে এক জোড়া হাত।

\
মাথার মুকুট দান করেন বেলেঘাটার রামনারায়ন সরকার, সোনার জিভটি পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ, গলার ১০৮ টি সোনার মুন্ডুমালা দেন পাতিয়ালার মহারাজা। তাই মুন্ডমালাও রয়েছে ১ জোড়া। আর মায়ের মাথার উপরে রূপোর ছাতাটা দান করেছিলেন নেপালের প্রধান সেনাপতি জং বাহাদুর মহাশয়। এতো গেল বাবু কলকাতার ধনকুবের এবং রাজা-গজার দান। সাধারণ ভক্তদের দেওয়া অলঙ্কারের তো লেখা জোকা নেই। কিছুদিন আগে( ২৩-১১-২০১৮) ডেইলি হান্টে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে জানতে পারি যে, ২০১৬ সালে দেবীর জিভটি নাকি ৪০ বছর পরে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান জিভটি নাকি ২ কেজি ১৯১ গ্রাম রূপোর উপরে ৫৫৮ গ্রাম সোনা দিয়ে মোড়ানো। মায়ের খড়্গটিও নাকি পাল্টিয়ে দিয়ে একটি ২ কেজি ওজনের নতুন সোনার খাঁড়া দেওয়া হয়েছে।

কালীঘাটের কালী- দক্ষিনাকালী, পীঠরক্ষক লিঙ্গ রূপী ভৈরব নকুলেশ্বর। এই ভৈরব রূপী শিব লিঙ্গটি নাকি ব্রহ্মানন্দ গিরির পূজিত। বর্তমান মন্দিরটি ১৮৫৪ সালে নির্মাণ করেন তারা সিং নামক এক পাঞ্জাবী ভক্ত। নকুলেশ্বর উৎসব হয় শিবরাত্রি ও নীলষষ্ঠীর দিনে।

মন্দিরের ৬ টি অংশে রয়েছে ষষ্ঠী তলা, নাট মন্দির, জোড় বাংলা, হারকাঠতলা, রাধা-কৃষ্ণ মন্দির এবং কালী কুন্ড।
পূবদিকে রয়েছে কালী কুণ্ড। ভক্তদের কাছে এর জল খুবই পবিত্র। বর্তমান মন্দির নির্মাণের আগে, এই স্থলে যে মন্দিরটি ছিল সেটি কে নির্মাণ করেছিল ঠিক করে কোন প্রমাণ নেই। কেউ বলে প্রতাপাদিত্য কে হারিয়ে আকবরের শ্যালক রাজা মানসিং এটি নির্মাণ করেন, আবার কেউ কেউ এর নির্মাণ কৃতিত্ব দেন রাজা বসন্ত রায় কে।

কালীঘাটের সেবায়েতদের পদবি হালদার। এঁদের উৎপত্তি ভুবনেশ্বর ব্রহ্মচারীর জামাই- ভবানীদাস হতে। ভবানীদাস যেহেতু বৈষ্ণব ছিলেন তাই তিনি কালী মন্দিরের পশ্চিমে শ্যাম রায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান শ্যামরায়ের
মন্দিরটি অনেক পরে ১৮৪৩ সালে বানিয়ে দেন বাওয়ালির জমিদার উদয়নারায়ন মন্ডল।

ভবানীদাসের অধস্তন পঞ্চম পুরুষরা নাকি বর্গী সর্দার ভাস্কর পন্ডিতের কাছ থেকে হাওলাদার উপাধি প্রাপ্ত হন, যা পরে হয়ে দাঁড়ায় হালদার। সব জায়গায় অদ্ভুত সব ঘটনা- শৈব বর্গীরা তাদের কালীঘাটের “হাওলা” নাকি দান করে গেছেন।
সে যাই হোক কবি ঈশ্বর গুপ্ত এই হালদারদের গুণাবলী নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন, এবং হালদারদের নামকরণ করেছিলেন ” কলির দেবল” বলে। বাবু যুগে মায়ের কাছে হাজারে হাজারে পাঁঠা বলি হত, সেই বলির মাংসের একটি অংশ যেত এদের ঘরে। তাই কৌতুক করে কবি লিখলেন-
” প্রতি কোপে যত পাঁঠা বলিদান করে।
দেবী বরে জন্মে তারা হালদারের ঘরে।।
এক জন্মে মাংস দিয়া আর জন্মে খায়।
কলির দেবল হয়ে কালীগুন গায়।।”

এখানে একটি কথা বলি, মদ্য পান আর পাঁঠার মাংসের কদর বাবুদের হাত ধরে, আমজনতার মধ্যেও তখন ভাইরাসের মতন ছড়িয়ে পড়েছিল। কালীঘাটের মন্দিরে নিত্যকার আমিষ ভোগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ। তাঁর দেওয়া পাঁঠা সর্বাগ্রে বলি দেওয়া হত। কিভাবে যেন রটিয়ে দেওয়া হয়, হিন্দু ধর্মে বলির মাংসই একমাত্র ভোজ্য, বাকি মাংস নাকি “বৃথা মাংস”। তাই ধর্মভীরু পাবলিকের জন্য রাতারাতি, শয়ে শয়ে গড়ে উঠল কসাই কালীর দোকান। ভাবছেন বোধহয় এ আবার কি ? পাঁঠার দোকানের এককোনে, কালী মূর্তি রেখে, বলি দিলে নাকি সেই মাংস হয়ে যেত প্রসাদী মাংস। এরপরে মদ্য সহযোগে সেই প্রসাদী মাংস ভোজন , সেকাল- একাল মিলে এক হয়ে যেত।

ভাবনার বিষয়-

আদিতে কালী পুজো হচ্ছে অস্ট্রিক জাতি ও অস্ট্রিক সভ্যতার অবদান। তারাপীঠ, কামাখ্যা, কলকাতার কালীঘাট বা বেশির ভাগ শক্তিপীঠ গুলির দেবীর মূল রূপ যদি দর্শন করে থাকেন তবে অবশ্যই দেখেছেন যে বাইরের মুর্তিরূপ নয়, ভিতরে দেবীর আদি রূপ হচ্ছে শিলা। শিলা প্রতীক কিন্তু আর্য সভ্যতার দান নয়, অস্ট্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবদান। দিগম্বরী , ভয়ঙ্করী, কৃষ্ণকালী দেবী মূর্তিও অস্ট্রিক সংস্কৃতির অবদান। আদিবাসীদের পূজ্য দেবদেবীরা প্রায় সবাই করাল দর্শন, পক্ষান্তরে আর্য দেব দেবীরা প্রায় সবাই শ্বেত শুভ্র, সৌম দর্শন। আবার কালী পুজোয় কারণ বারি সেবন এবং বলি প্রথাও নির্দেশ করে এর অস্ট্রিক অরিজিন। পরে আর্য সভ্যতার প্রভাবে সংস্কৃত মন্ত্র, অমাবস্যা তিথিতে পুজো, যজ্ঞের হোমাগ্নি ইত্যাদি যুক্ত হয়েছে। বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কের মতে কালী পুজোয় ডাকিনী – যোগিনী, ভূত -প্রেত ইত্যাদির সংযুক্তিকরণ সম্ভবত মঙ্গলোয়েড প্রভাব নির্দেশ করে।অর্থাৎ কালী পুজো আদিতে অস্ট্রিক পরে আর্য ও অনার্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিলন নির্দেশ করে।শুধু তাই কেন- শিলা বা পাথর পুজো, নদ – নদীর পুজো, গাছ পালার পুজো, বনদুর্গা পুজো, অলক্ষী পুজো, এমনকি কৃত্তিবাস ওঝার প্রচলিত গণেশের পাশে নব পত্রিকা স্থাপন অস্ট্রিক সভ্যতার বৃক্ষ পূজারই পরিবর্তিত রূপ বলে ধরা যায়।

বস্তুবাদী ঐতিহাসিকদের মতে বহু বৌদ্ধ ও জৈন দেবদেবীর মূর্তি, ব্রাম্মন্যবাদি সমাজ আত্মিকরন করে নিয়েছে। ঠিক বিশ্বাস হচ্ছেনা, তাহলে চলুন অম্বিকা দেবীর গল্প বলি।জৈন দেবী অম্বিকার উপাসনা, সম্ভাব্যরূপে খ্রিস্টীয় ১০/১১ শতক থেকে খ্রিস্টীয় ১৩/১৪ শতক অবধি, জৈনদের দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে আলাদা আলাদা গাত্রবর্ণের হতেন এই দেবী- যেমন সাদা, টকটকে লাল, হলুদ ইত্যাদি। কখনও তিনি দ্বিভুজা, কখনও চতুর্ভূজা, অষ্ট ভুজা এমনকি কুড়ি হাতের দেবী অম্বিকার কথাও জানা যায়। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি জৈন দেবদেবীও আস্তে আস্তে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ও হিন্দু দেবদেবীদের ন্যায় পুজোপাঠ পেতে লাগলেন। দেবীর বিভিন্ন হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, ধনুক, আম্রপল্লব, সাপ ইত্যাদি শোভিত হতে লাগল। অম্বিকাদেবী সিংহবাহিনী তাই ক্রমে ক্রমে ধর্মীয় আত্মিকরণের হাত ধরে হিন্দু বাঙালি সমাজে দেবী অম্বিকা অতি সহজেই মা চন্ডী ও মা কালীর মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়ে মা চন্ডী রূপে বাঁকুড়ার অম্বিকানগরে এবং মা সিদ্ধেশ্বরী কালী রূপে বর্ধমানের অম্বিকা কালনায় পূজিত হতে লাগলেন। এরকম বহু ঘটনা উদাহরণ হিসেবে
দেওয়া যায়।

তাই আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, হয়ত একসময় ব্রহ্মার বেদী বলে স্থানটি হয়ত ছিল কোন বৌদ্ধ স্তুপ। স্তুপ তৈরি করার জন্য মাটি কাটার ফলে তৈরি হয়েছিল জলাশয়, যেটি হয়ত বর্তমান কালী কুণ্ড।
মনে রাখতে হবে পাল যুগ অবধি বাংলা এবং মগধের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ। পাল পরবর্তী যুগে বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের মধ্যে মিসিং লিঙ্ক হিসাবে এই স্থানটিতে কয়েকটি প্রস্তরখন্ড রেখে ধর্ম ঠাকুরের থান গড়ে উঠেছিল। এই প্রস্তরখন্ড হয়ত আরো পরে কোন কালী সাধক দ্বারা মাতৃ মুর্তিরূপে পূজিত হতে থাকেন।

শেষ করছি মায়ের মন্দিরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুজোর বিবরণ দিয়ে, এটি লিখেছেন মার্শম্যান সাহেব - “Last week a deputation from the Government went in procession to Kalighat and made a thanks giving offering to this Goddess of the Hindus, in name of the company, for the success which the English have lately obtained in this country. Five thousand rupees were offered. ”

✍️ ডঃ তিলক পুরকায়স্থ
তথ্যসূত্র- ১) কলকাতা বিচিত্রা, রাধারমণ রায়, দেব সাহিত্য কুটির, জানুয়ারি ২০১১
২) ইতিহাসের কলকাতা, সংগ্রহ সম্পাদনা কমল চৌধুরী
৩)বাবু গৌরবের কলকাতা, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়
৪) আদিবাসী সমাজ ও পালপার্বন : ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে
লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
৫) কৌলাল