Pallabi Biswas's Album: Wall Photos

Photo 1 of 6 in Wall Photos

#মহান_প্রাণ_নীলরতন_সরকার

১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনে ঝাঁপিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্তু কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আমৃত্যু বজায় ছিল।

স্বদেশি শিল্প বিস্তারের ভাবনায় সাবান তৈরির ব্যবসা, চা ও চামড়ার ব্যবসা খুলেছিলেন। তবে ব্যবসায়ী তিনি কোনও দিনই ছিলেন না। ফলে জগদীশচন্দ্র বসুর বাবা ভগবানচন্দ্র বসু ও রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো প্রভূত লোকসান হয়েছিল তাঁর।

দেনার দায়ে সাধের বসতবাড়ি বিক্রি করতে হয়। তাতেও আক্ষেপ ছিল না। বলেছিলেন, ‘‘কাজ তো আরম্ভ করা গেল, ফল আজ না হয় কাল পাওয়া যাবে। টাকাকড়ি সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন। আসে আর চলে যায়। গেলে কোনও দুঃখ নেই।’’

তৎকালীন ছোটলাট লর্ড কারমাইকেলের সঙ্গে দেখা করে নীলরতন জানালেন, বাঙালি ছাত্রদের জন্য স্বদেশি মেডিক্যাল কলেজ বানাতে চান। সরকারের অনুমোদন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দরকার।

সাহেব ধুরন্ধর। বললেন, ‘‘আপনি চাইলে না বলি কী করে। তবে রাজকোষের অবস্থা ভাল নয়। এক মাসের মধ্যে আপনি এক লাখ টাকা জোগাড় করলে কলেজ হবে। অনুমোদন দেব।’’ তখনকার এক লাখ টাকা আজ প্রায় ১০ কোটি!

স্নায়ুযুদ্ধে বাঙালি চিকিৎসক টললেন না। সাহেবের চোখে চোখ রেখে চ্যালেঞ্জ নিলেন।

দুরন্ত পসার তাঁর। শহরের তাবড় ধনী তাঁর রোগী। সবাই সাহায্য করলেন। বন্ধু রবীন্দ্রনাথ অভিজাত মহলে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে অনেক টাকা তুললেন। নীলরতন বাকিটা ধার করলেন বন্ধুদের থেকে।

সময়সীমার শেষ বিকেলে টাকার থলি হাতে বাঙালি ডাক্তারকে ঢুকতে দেখে সাহেব স্তম্ভিত। কোনও মতে নিজেকে সামলে প্রস্তাবিত কলেজের নাম জিজ্ঞেস করলেন।

নীলরতন হেসে উত্তর দিলেন, ‘কেন? আপনার নামে! কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ।’ কারণ তিনি জানতেন, স্বদেশি নাম হলে পদে পদে বাধা আসবে। বড়লাটের নামে হলে মুহূর্তে সব অনুমোদন মিলবে। সেটাই হল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘সেঁজুতি’ কাব্যগ্রন্থ।

আত্মার আত্মীয়তা ছিল দু’জনের। কবি তাঁকে স্নেহভরে ডাকতেন ‘নীলু’ নামে।

নিয়মিত কবিকে পরীক্ষা করা, বিদেশ যাওয়ার আগে স্বাস্থ্যপরীক্ষা, টাউন হলে কবির বক্তৃতার আগে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে মঞ্চে অপেক্ষা করা— সব দায়িত্বে নীলরতন। তাঁর দার্জিলিংয়ের বাড়িতে যেতেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে কবির লেখাপড়ার ঘর তৈরি করা, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের জন্য বাড়ির বারান্দা কাচ দিয়ে ঢেকে কাঠের কাজের ওয়ার্কশপ, প্রতিমাদেবীর ছবি আঁকার স্টুডিয়ো— সব আয়োজন করেছিলেন নীলরতন।

শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রস্টেট গ্রন্থির সমস্যায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। নীলরতন ও বিধানচন্দ্র রায়ের পরামর্শে তাঁকে কলকাতায় আনা হল। বিধানচন্দ্র, চিকিৎসক ইন্দুভূষণ বসু, ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিলেন। তাতে সায় ছিল না নীলরতনের। বলেছিলেন, ‘‘একটা কথা মনে রেখো, রোগী অন্য কোনও লোক নন, স্বয়‌ং রবীন্দ্রনাথ।’’ তবু অস্ত্রোপচার হল। শেষ সময়ে নীলরতনকে যখন ডেকে আনা হল, তখন কিছু করার নেই। প্রশান্তচন্দ্রের লেখায় পাওয়া যায়, ‘‘তখন আর সময় নেই। সব্যসাচীর হাত থেকে তখন গাণ্ডীব পড়েছে খসে। দুই চোখ তাঁর জলে ভরে এল।’’

ষোলো টাকা ভিজিট ছিল তাঁর প্রখর আত্মসম্মানের প্রকাশ।

ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে ষোলো টাকার দাবিদার ছিলেন ‘সাহেব ডাক্তার’রাই। প্রথাটা ভাঙলেন নীলরতন সরকার, বাঙালির কাছে যিনি এখন এন আর এস-মাত্র।

১৯৪৩ সালের ১৮ মে, শুক্লা চতুর্দশীর দুপুরে অবসান হয় তাঁর জীবনের।

স্মরণ করি শ্রদ্ধায়।

ঋণ: রোগীদের ‘জীবন্ত ঈশ্বর’ নীলরতন সরকার - পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় (আনন্দবাজার আর্কাইভস)

✍ প্রীতম চট্টপাধ্যায়
(The Bengal Owl র পেজ থেকে)