আগামী দিনের মা-দের জন্য
বেশ কিছু দিন আগে আমেরিকাতে রামকৃষ্ণ মিশনের একজন মহারাজকে কিছু ভক্ত প্রশ্ন করেছিল, মহারাজ, এত মহাপুরুষ কিভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম নিতেন ? আর বর্তমানে কেন আর সেই মহাপুরুষরা জন্মায় না ? অসাধারণ উত্তরে মহারাজ বলেছিলেন, "আকাশে প্লেন ওড়ে, সে তো আর যেখানে সেখানে ইচ্ছামত নামতে পারে না ! তার নামার জন্য উপযুক্ত এয়ারপোর্ট প্রয়োজন হয় ! ঠিক সেই রকম এক সময় ছিল যখন এই ভারতবর্ষে উপযুক্ত 'মা' ছিল। এখন সেই এয়ারপোর্ট নেই, তাই বড় বড় প্লেন আর নামতে চাইলেও পারছে না"।
আধুনিক মনঃ বিজ্ঞানের মতে, সন্তান কেমন মানুষ হবে সেটা ৮৫% নির্ভর করে মা-এর উপর। আর তা নির্ধারণ হয়ে যায় মায়ের গর্ভে সন্তান আসা এবং জন্মের ৫ বছরের মধ্যে। মায়ের চিন্তা, কথা, ভালো লাগা- মন্দ লাগা, রুচি, আদর্শ, সন্তানের উপর দারুনভাবে প্রভাব ফেলতে থাকে গর্ভে থাকা অবস্থাতেই। মায়ের কষ্ট, তার কষ্ট। মায়ের আনন্দ, তার আনন্দ। মায়ের খাবার, তার খাবার। তাহলে মায়ের ইচ্ছা, তার ইচ্ছা হবে না কেন ! মায়ের আদর্শ তার আদর্শ, মায়ের জীবনবোধ, সন্তানের জীবন বোধ হবে। সেখান থেকেই তার শিক্ষা শুরু- 3 Idiots এর All is Well এর মত।
আমরা আজও সে যুগের কৌশল্যাকে মনে রাখি, পুত্র রামের কারণে। 'মা' মেরিকে জানি, মহাবতার যীশু খ্রিষ্টের মাতা বলে। 'মা' আমেনাকে ভুলিনি, মহানবী হযরত মুহম্মদ এর কারণে। আর এ যুগে ভুবনেশ্বরী দেবীকে চিনি কারণ, তিনি স্বামী বিবেকানন্দের 'মা' ছিলেন। প্রভাবতী দেবীকে চিনি, কারণ তিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর 'মা' বলে। ভগবতী দেবীকে চিনি, কারণ তিনি বিদ্যাসাগরের 'মা' ছিলেন। সারদা দেবীকে মনে রেখেছি, কারণ তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গর্ভধারিণী ছিলেন। যুগে যুগে কত মহাপ্রান এসেছেন আমাদের পথ দেখানোর জন্যে। বারে বারে তারা আমাদের বলেছেন, যদি জীবন সার্থক করতে চাও, তাহলে এই পথে এসো। আমরা তাদের কথা না শুনে চলি উল্টো পথে।
এখন কার সময়ে কয়জন বাবা-মা আছেন, যারা এমন সন্তান চান ? আমাদের কি অহঙ্কার- আমরা আধুনিক, আমরা বিজ্ঞান মনস্ক, আমাদের ভদ্রতা - সভ্যতা গাদা-গাদা বই পড়ায়, অনেক সার্টিফিকেটে, ভাল রোজগারে, ফ্ল্যাট, গাড়ি-বাড়ি, স্যুট-বুট, দামি শাড়ি, গয়না, Internet, i-phone, i-pad, Tablet, Capsule... কিন্তু কত আশা নিয়ে ছোট্ট দেব শিশুটি অন্ধকার জগৎ থেকে এলো, তাকে কি আমরা সত্যিকারের আলোর সন্ধান দিতে পারছি ? সে পথ তো আমাদেরই অচেনা।
ছোট্ট নরেন (তখনও বিলে) একটা অন্যায় করল। মা তাকে কোন কটু কথা না বলে, কোনও শাস্তি না দিয়ে, একটা কাগজে সেটি লিখে ঘরে টানিয়ে দিলেন। দুরন্ত বিলের পড়ায় মন নেই, মা পড়ছেন, বিলে শুনছে, সব আয়ত্ত হয়ে যাচ্ছে। মা শিক্ষা দিচ্ছেন,"বাবা, জীবনে যেটা সত্য বলে জানবে, কখনও সেই আদর্শ থেকে সরে এস না।" তাই তো পরবর্তীতে আমরা পেলাম "সত্যের জন্যে সব কিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনও কিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।" "ছোট বেলায় মায়ের কাছেই জীবনে বড় হওয়ার সব শিক্ষা পেয়েছি, তাই বলতে পারি- সত্যই আমার ঈশ্বর, সমগ্র জগৎ আমার দেশ, জগৎ এর সবাই আমার ভাই, আমার রক্ত।" এই হল যথার্থ 'মা' এর শিক্ষা।
১৪ / ১৫ বছরের সুভাষ বসু 'মা' কে চিঠি লিখছেন- "তোমরা আমার কাছে কি চাও মা ? তোমরা কি চাও আমি লেখাপড়া শিখে ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার হই। আমার অনেক টাকা, বাড়ি-গাড়ি হোক। নাকি এই চাও- আমি পৃথিবীর সবথেকে গরীব হব। কিন্তু এমন মানুষ হব, যেন শ্রদ্ধায় পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ মাথা নিচু করে।" ক'জন বাবা-মা আছি আমরা, সৎ সাহস নিয়ে আমাদের সন্তানদের এই উৎসাহ দিতে পারি! বলি শুধু পড়, ভালো রেজাল্ট করো, টাকা রোজগার করার একটা মেশিন হয়ে ওঠো। আমরা শেখাই, কি করে সে মিথ্যাবাদী হতে পারে, কি করে সে আরও স্বার্থপর হতে পারে। ছোট শিশুর কোমল অন্তরে এই 'বিষ-বৃক্ষ' আমরাই লাগিয়ে দিই। আর সত্যিই এক সময় যখন সে আবেগহীন, ভালবাসা হীন, বিবেকহীন মেশিনের মত আচরণ করে, তখন আমরা বুক চাপড়াই। আমরা প্রত্যেকেই দ্রুত গতির এক ব্রেকহীন গাড়িতে উঠেছি, যার গতি শুধু বাড়তে পারে কমে না। আমরা ভেসে চলেছি...... সন্তানদেরও তুলে দিচ্ছি ব্রেক ফেল করা আর এক গাড়িতে। এই গাড়ি কখন থামবে!!! যখন সব শেষ !!! নবনী দাদা (Founder, Akhil Bharat Vivekananda Yuva Mahamondal), চরিত্র গঠন বই এর এক জায়গায় লিখেছেন, "বুদ্ধিমান দেখে শেখে আর বোকা ঠেকে শেখে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ, না দেখে শেখে, না ঠেকে শেখে।" আমরা আমাদের চারপাশের এই অসহনীয় পরিস্থিতি দেখে তো শিক্ষা গ্রহন করি না, এমনকি ঠেকেও শিখি না।
সুভাষ চন্দ্র বসু যখন তার মা-কে ঐ চিঠি লেখেন, সম্ভবত তার আগেই স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শের সাথে পরিচয় ঘটেছে। তিনি পরবর্তীতে বলেছেন-" বিবেকানন্দের আদর্শকে যে সময়ে জীবনে গ্রহন করেছিলাম, তখন আমার বয়স বছর পনের হবে কিনা সন্দেহ। স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাব আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল।" “......ত্যাগে তিনি বেপরোয়া, কর্মে তিনি বিরতিহীন, ভালবাসায় তিনি সীমাহীন, জ্ঞানে তিনি প্রগাঢ় ও বিচিত্রগামী, আবেগে তিনি প্রাণোচ্ছ্বল, আক্রমণে তিনি করুণাহীন তথাপি শিশুর মত সরল, আমাদের পৃথিবীতে তিনি ছিলেন এক বিরল ব্যক্তিত্ব।” রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে একসময় নেতাজীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় স্বামী বিবেকানন্দের একটা জীবনী লেখার জন্য। তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন- "আপনাদের এই প্রস্তাব পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি, গর্বিত বোধ করছি। কিন্তু এত বড় শক্ত কাজ আমি পারব না। কারণ স্বামী বিবেকানন্দ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে আজ আপনারা যাকে নেতাজী বলে সম্মান করেন, সে সব কাজ ছেড়ে স্বামী বিবেকানন্দের পায়ের কাছে পড়ে থাকতো।" এমন আদর্শ আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরব না !
ঘরের সব ফটো সরিয়ে ফেলে, এমন মহাপুরুষদের ফটো, তাদের অমৃত বানী আমাদের সন্তানের সামনে তুলে ধরি। তারও আগে সেই বানী আমাদের জীবনে অভ্যাস করে নিজের জীবনটা সুন্দর করি। জগৎ 'মাতা' সারদার শেষ বানী- "যদি শান্তি চাও মা, কার দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। পৃথিবীর সবাই তোমার আত্মীয়, কেউ পর নয়।" এমন একটা কথা যদি জীবনে প্রতিফলিত করা যায়, তা হবে স্বামী বিবেকানন্দের কথায়- "আমরা পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে, সেখান থেকে দেবত্বে নিজেকে নিয়ে যেতে পারি।" আমরা নিজেকে উন্নত করার এই চেষ্টা থেকে কখনও বিরত হবো না। কারণ এই চেষ্টা যে জীবনে নেই, সেটা আর যাই হোক মানুষের জীবন নয়।
এমন জীবন লাভ করলে কি হবে-- আমরা দেবতা হয়ে উঠবো। আমরা যেখানে থাকব, সেটা হবে মন্দির। আমাদের কাছের মানুষ গুলোর "দেবী" দর্শন হবে। আমাদের সন্তান বলবে- 'দুর্গা, কালি, লক্ষ্মী, সরস্বতী বুঝি না, আমার 'মা' আমার ''দেবী'', আমার পৃথিবী, আমার আদর্শ।' আমাদের এই সন্তান কখনও পশুর মত আচরণ করতে পারে না। সমাজের আতঙ্ক সে হতে পারে না। সে শিক্ষক হলে ক্লাসে ফাঁকি না দিয়ে, জীবন্ত দেবতার পুজা করবে। ডাক্তার হলে, রুগিকে নিয়ে ব্যবসা করবে না। ইঞ্জিনিয়ার বা সরকারী কর্মচারী হলে পশুর মত দেশের গরীব- দুঃখী সাধারণ মানুষ গুলোর মুখের খাবার কেড়ে খাবে না।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রত্যেককে একটি গাছ লাগানর কথা বলা হয়। আমরা প্রত্যেকে যদি নিজে দেবতা হয়ে উঠি এবং একটি করে "দেব-বৃক্ষ" সমাজের মাটিতে লাগাতে পারি, তাহলে আমাদের জীবন তো সার্থক হবেই, সেই সাথে ঐ "দেব-বৃক্ষ" থেকেও অমৃত ফল ফলতে থাকবে। আমরা তেমন "দেবী- মা" হয়ে উঠি, যেন আমাদের সন্তান বলতে পারে- " মা-গো, আমি যখন 'মা' কথাটি লিখি, তখন আমার লেখার কাগজ, আমার হাতের কলম পবিত্র হয়ে যায়। আর আমি যখন তোমায় 'মা' বলে ডাকি, তখন আমার শরীর পবিত্র হয়ে যায়, আমার সমস্ত মন উৎসাহে, আনন্দে ভরে ওঠে। আমাকে তুমি আশীর্বাদ করো 'মা'- আমি যেন তোমার পবিত্রতা রক্ষা করতে পারি, আমি যেন তোমার যোগ্য সন্তান হয়ে উঠতে পারি।'
--------------------------------------------------------
Tagged: